মো.হুমায়ুন কবির,গৌরীপুর
ময়মনসিংহের গৌরীপুর হারিয়ে গেছে গ্রামীণ ঢেঁকি। বাংলার গ্রামীণ রমনীরা ধান ভানা, হলুদ কুটা, মোটর শুটি, ডাল কুটা ও পৌষ পার্বণে পিঠা তৈরির জন্য চাউলের গুরা কুটার জন্য ঢেঁকি ব্যবহার করতো। এখন আর গ্রাম বাংলায় ঢেঁকি দেখা যায় না বললেই চলে।
এক সময় গ্রাম বাংলায় ধান ভানার একমাত্র যন্ত্রই ছিল ঢেঁকি। প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে ঢেঁকি ব্যবহার হয়ে আসছে। তখন বাংলার ঘরে ঘরে ধান ভানা, চিড়া কুটা, চালের গুঁড়া করার জন্য ঢেঁকিই ছিল একমাত্র মাধ্যম। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ঢেঁকি গৃহস্থের স্বচ্ছলতা ও সুখ সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে প্রচলিত ছিল।
গ্রামের ঘরে ঘরে এখন আর আগের মত চোখে পড়ে না ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি। আজানের সাথে সাথে ভোরের স্তব্ধতা ভেঙ্গে ঢেঁকির ঠক ঠক শব্দ আর কানে আসে না। যেখানে ঢেঁকি ছাড়া গ্রাম কল্পনা করাও কঠিন ছিল। যেখানে বসতি সেখানেই ঢেঁকি। কিন্তু আজ তা আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য থেকে মুছে যাচ্ছে।
এ প্রজন্মের ছেলে যার বয়স হবে ১০। ৫ম শ্রেনী শিক্ষার্থী। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়ছিল যে সে ঢেঁকি চিনে কিনা না। সে উত্তরে বললো এটা কি জিনিষ। জানা গেল সে ঢেঁকি চিনে না।
মাছে ভাতে বাঙালির ঘরে একসময় নবান্নের উৎসব হতো ঘটা করে। উৎসবের প্রতিপাদ্যটাই ছিল মাটির গন্ধ মাখা সুগন্ধী ধান, ঢেকি ছাঁটা চালের ভাত আর সুস্বাদু পিঠার আয়োজন। রাতের পর রাত জেগে শরীরটাকে ঘামে ভিজিয়ে ঢেঁকিতে ধান ভানার পর প্রাণ খোলা হাসি হাসত বাংলার রমণীরা। সেই ঢেঁকির এখন প্রস্থান ঘটেছে। কালের বিবর্তনে আর যান্ত্রিক সভ্যতার আগ্রাসনে অধুনিক এই যুগে গ্রাম বাংলার ঢেঁকি আজ বিলুপ্তির পথে।
মূলত ৮০ দশকের পর ইঞ্জিন চালিত ধান ভাঙ্গা কল আমদানির পর গ্রাম অঞ্চল থেকে ঢেঁকির অবসান হয়েছে। ক্রমান্বয়ে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন গ্রামের মানুষ ভুলে গেছেন ঢেঁকি ছাঁটা চালের স্বাদ আর তরুণ প্রজন্ম তো চেনেই না- এই যন্ত্রটি। যান্ত্রিক সভ্যতা গ্রাস করেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঢেঁকি শিল্পকে। ডিজিটাল যুগে তরুণ প্রজন্মরা ঢেঁকি কি তা চেনবেই না। হয়তো ঢেঁকির স্থান হবে যাদুঘরে।
ঢেঁকি ছাঁটা চাল শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। গ্রামের মেয়েরা পালাক্রমে ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল তৈরির সময় হরেক রকম গীত পরিবেশন করত। আমোদ-আহলাদে ধেই ধেই করে নাচতো আর গাইতো। উহ্! সে কি আনন্দ! যা কেবলই স্মৃতি। সব এলাকাতেই আধুনিক যুগে ঢেঁকির পরিবর্তে ধান ছাঁটাইসহ চালের গুঁড়া তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ চালিত মেশিনে।
একটা সময় ছিল যখন শীতকালে গ্রাম বাংলার প্রায় সব বাড়িই ঢেঁকির ধুপুর ধাপুর শব্দে মুখর থাকতো। ঢেঁকি ছাঁটা চালের গুড়া হতে তৈরি হত রকমারি পিঠা-পায়েশ। বাড়ি বাড়ি পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত। নতুন জামাইদের সে পিঠায় আপ্যায়ন করতো শাশুড়ি। একসময় ঢেঁকির সুরেলা শব্দ গৌরীপুরের প্রতিটি ঘরে ঘরে শোনা যেত।
ঢেঁকিতে ধান ভানা আজ নেই বললেই চলে। বর্তমান যুগে রাইস মিলে ও ভ্যান গাড়িতে ভ্রাম্যমাণ ইঞ্জিন নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান ভানছে অনেকেই। যার কারণে গ্রামের অসহায় ও অভাবগ্রস্থ মহিলারা যারা ধান ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা বিকল্প পথ বেছে নেওয়া ছাড়াও অনেকে ভিক্ষা করে দিন অতিবাহিত করছে। এমনি একজন জহুরা খাতুন বলেন এখন সবই স্মৃতি। সংসার চালাতে হিমসিম খাইতে হচ্ছে। যখন যে কাজ পাই তখন সেটাই করি।
ঢেঁকি আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির এক অপূর্ব নিদর্শন। যখন যন্ত্রচালিত ধান ভানা কল ছিল না তখন ঢেঁকির কদর বেশ ছিল। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে এখন পুরোপুরি ঢেঁকি বিলিন হয়ে গেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুরনাহার লিপি বলেন, সরকারি বা বেসরকারিভাবে আমাদের হারানো ঐতিহ্যগুলো নিয়ে বিশেষ মেলার আয়োজন করলে বর্তমান প্রজন্ম ঢেঁকিসহ হারানো ঐতিহ্যগুলো চিনতে পারবে এবং তা রক্ষায় এগিয়ে আসবে।