পশ্চিমাদের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের ইরানের ওপর জাতিসংঘের কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে চলেছে। শনিবার রাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে যাচ্ছে বলে এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। শুক্রবার জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিয়েছে, তাদের পরিদর্শকদের ইরানি স্থাপনাগুলোতে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক সপ্তাহের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পরও পশ্চিমা শক্তিগুলো বলছে, নিষেধাজ্ঞা বিলম্বিত করার মতো যথেষ্ট অগ্রগতি হয়নি। ইউরোপীয় শক্তিগুলো এক মাস আগে ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা ‘স্ন্যাপব্যাক’ বা পুনর্বহালের প্রক্রিয়া শুরু করে। তাদের অভিযোগ, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা ইসরায়েলি ও মার্কিন হামলার জবাবে গৃহীত পাল্টা ব্যবস্থার অংশ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
নিষেধাজ্ঞাগুলো রবিবার (নিউইয়র্ক সময় শনিবার রাত ৮টা) কার্যকর হওয়ার কথা। এগুলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির অভিযোগে অভিযুক্ত কম্পানি, ব্যক্তি ও সংস্থার সঙ্গে বৈশ্বিক লেনদেন নিষিদ্ধ করবে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যখন চাপ দিয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে দুর্বল করতে চাইছে, তখন কোনো সমঝোতায় যাওয়ার কারণ নেই। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘যদি লক্ষ্য হতো পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ সমাধান করা, আমরা সহজেই তা করতে পারতাম।’ তিনি আবারও জোর দিয়ে বলেন, ইরান কখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে না।
পেজেশকিয়ান আরো জানান, ফ্রান্স প্রস্তাব করেছে ইরান যদি তার উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ ত্যাগ করে, তবে নিষেধাজ্ঞা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু তার প্রশ্ন, ‘কেন আমরা নিজেদের ফাঁদে ফেলব এবং প্রতি মাসে গলায় ফাঁস দেব?’ তিনি আরো অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় দেশগুলোকে আপোষে না পৌঁছানোর জন্য চাপ দিচ্ছে।
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ও আলোচক স্টিভ উইটকফ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে ক্ষতি করতে চায় না এবং আরো আলোচনার জন্য উন্মুক্ত। তবে পেজেশকিয়ান অভিযোগ করেন, উইটকফের গুরুত্ব নেই এবং তিনি আগের আলোচনায় চুক্তি থেকে পিছিয়ে এসেছিলেন, যা ইসরায়েলের সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়।
রাশিয়ার অনীহা
ইরানের ওপর নতুন অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে এই নিষেধাজ্ঞা আনা হলেও তা সব দেশ কার্যকর করবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। রাশিয়ার উপ-রাষ্ট্রদূত দিমিত্রি পলিয়ানস্কি শুক্রবার বলেন, ইরানের ঘনিষ্ঠ অংশীদার মস্কো এসব নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালকে ‘অবৈধ’ বলে মনে করে।
রাশিয়া ও চীন শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদে এপ্রিল পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের জন্য প্রস্তাব তোলে, কিন্তু যথেষ্ট ভোট পায়নি। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং অন্য দেশগুলোকে ইরানি তেল কেনা বন্ধ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে, যদিও চীনের কিছু কম্পানি এই চাপ মেনে নেয়নি।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার মধ্যস্থতায় হওয়া ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে যান ট্রাম্প। এরপর ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতি চালু করেনও। ওই চুক্তিতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণের বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্ত ছিল।
নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো সেই ২০১৫ সালের চুক্তির অধীনে স্থগিত জাতিসংঘের পদক্ষেপগুলোর ‘স্ন্যাপব্যাক’ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা ট্রাম্পের সরে যাওয়ার পর ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি জোরালোভাবে সমর্থন করে। আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ইরান ইতিমধ্যেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করতে শিখেছে বলে স্ন্যাপব্যাক প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, স্ন্যাপব্যাক উল্টানো সহজ নয়, কারণ এতে নিরাপত্তা পরিষদে ঐকমত্য প্রয়োজন।
প্রতিবেদনটি সতর্ক করেছে, ‘এটি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রার সংকট ও অবকাঠামোগত সমস্যায় জর্জরিত ইরানি অর্থনীতির চারপাশে অস্থিরতা আরো বাড়াতে পারে।’ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শুক্রবার জাতিসংঘের এক বক্তৃতায় স্ন্যাপব্যাকে বিলম্ব না করার আহ্বান জানান এবং ইঙ্গিত দেন, জুনে ১২ দিনের বোমা হামলার পর ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে আবারও আঘাত হানতে ইসরায়েল প্রস্তুত। ওই হামলায় ইরানি কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী ১ হাজারের বেশি নিহত হয়েছিল।
পেজেশকিয়ান বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তাররোধ চুক্তি (এনপিটি) থেকে সরে গিয়ে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, নামহীন কিছু শক্তি ‘এ অঞ্চলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য অজুহাত খুঁজছে।’
সূত্র : এএফপি