অনলাইন ডেস্ক:
একদিকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় ও ভর্তুকির চাপ কমানো-এই দুই বিষয়কে সমন্বয়ের তাগিদ থেকে এরই মধ্যে পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। সঙ্গে সঙ্গেই ভোক্তাপর্যায়ে মূল্য বৃদ্ধির আবেদন নিয়ে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে হাজির হয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। অথচ রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি খরচ কমিয়ে দাম সহনীয় রাখার গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। তবে বরাবরই তা উপেক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থায় বিইআরসির ক্ষমতা আরও খর্ব হচ্ছে।
উৎপাদন ব্যয় কমাতে বিইআরসির অন্যতম প্রধান নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে- রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ না বাড়ানো। এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। এই খাতে বিপুল পরিমাণ টাকা বরাদ্দের জন্য সরকারি কোষাগারে চাপ পড়ায় অর্থনীতিতেও চাপ বাড়ছে-এমন ধরনের সমালোচনাও রয়েছে বিস্তর।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বারবার রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনা বন্ধ করার যুক্তি তুলে ধরলেও তা কাজে আসছে না। তাদের দৃষ্টিতে, ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে থাকা একটি প্রভাবশালী ‘সিন্ডিকেট’ এগুলো টিকিয়ে রাখছে। এমন অভিযোগের মধ্যে গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভায় এ-সংক্রান্ত আইনের (সংশোধন) খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আইনটি পাস হলে বিইআরসি ছাড়াই অধ্যাদেশ জারি করে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারবে সরকার। তবে বহুল আলোচিত-সমালোচিত কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়ে আগের অবস্থানেই রয়েছে সরকার।
পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আগে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি করত বিইআরসি। সে অনুযায়ী, উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের যুক্তিতে দাম বৃদ্ধি-হ্রাসের সিদ্ধান্ত মূলত তারাই দিত। তবে ভোক্তাদের ঘাড়ে বিদ্যুৎবিলের বোঝা কমাতে প্রতিবারই এ খাতে ব্যয় হ্রাসে নির্দেশনা জারি করে এসেছে তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, নির্দেশনাগুলো মানলে উৎপাদন খরচ কমত। তবে দাম বাড়িয়ে নেওয়ার পর বিইআরসিকে আর পাত্তাই দেয়নি পিডিবি। নতুন আইন পাস হলে পরিস্থিতি কী হবে, তা অনুমান করা যায়।
চলতি মাসের ২১ তারিখ পিডিবির প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে বিইআরসি। এর আগে ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মূল্য বৃদ্ধি করেছিল। দুবারই মূল্যবৃদ্ধির আদেশের সঙ্গে দাম নিয়ন্ত্রণের রূপরেখা হিসেবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের সঙ্গে সরকারের চুক্তি নবায়ন না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তা না শুনেছে পিডিবি, না সরকার।
বিইআরসি ২০২০ সালের আদেশের ৮-এর ১০ ধারায় কড়া ভাষায় বলেছিল, ‘তেলভিত্তিক রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি বর্তমান মেয়াদকাল শেষ হবার পর পুনরায় তা বৃদ্ধি করা যাবে না।’
এই আদেশ কেউ আমলে নেয়নি। জনগণের উদ্বেগ, বিশেষজ্ঞদের সমালোচনা ও বিরোধী দলগুলোর আপত্তির মুখে গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর সংসদে নতুন বিল পাস করে সরকার।
দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে ২০১০ সালে বিশেষ বিধান রেখে সাময়িক একটি আইন করেছিল সরকার। কয়েক দফা তার মেয়াদ বাড়িয়ে তা ২০২১ পর্যন্ত করা হয়। গত বছর ১৬ সেপ্টেম্বর ‘বিদ্যুৎ ও জ্বলানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (সংশোধন) বিল-২০২১’ আইনটির মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়। এই আইনবলে উৎপাদন না করেই বসে বসে সরকারি কোষাগারের টাকা পাচ্ছে কেন্দ্রগুলো।
নতুন আইন করার পর সুর নরম করতে দেখা যায় বিইআরসিকে। গত ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধির আদেশের ১৩-এর ১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘তেলভিত্তিক রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি বর্তমান মেয়াদকাল শেষ হবার পর পুনরায় মেয়াদ বৃদ্ধি না করাই সমীচীন।’
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, আগে যেখানে বিইআরসি বলেছিল চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো যাবেনা, এবার সেখানে বলছে সমীচীন নয়। বিইআরসির এই নমনীয়তার নেপথ্যে কথিত ‘সিন্ডিকেটের’ চাপ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।